
গ্রামীণ তাঁতশিল্প: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও টিকে থাকার সংগ্রাম
বাংলার তাঁতশিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি ঐতিহ্য, একটি সংস্কৃতি। শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা এই শিল্প আজও বয়ে চলেছে অতীতের গৌরব। তবে সময়ের সাথে সাথে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়ে এখন এই শিল্প টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত।
তাঁতশিল্পের ইতিহাস প্রাচীন, যার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় সুলতানি ও মোগল আমলে। ঢাকাই মসলিন ও জামদানি একসময় বাংলার বিশ্বজয়ী পণ্য ছিল। হস্তচালিত তাঁতের নিপুণ কারিগররা তৈরি করতেন বিশ্বের সেরা সূক্ষ্ম বস্ত্র। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে করের বোঝা, নিষেধাজ্ঞা এবং শিল্প বিপ্লবের যন্ত্রচালিত উৎপাদন পদ্ধতির চাপে ভেঙে পড়ে বাংলার তাঁতশিল্প।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর, ধনেখালি, মামুদপুর এবং বাংলাদেশের টাঙ্গাইল, নরসিংদী, সোনারগাঁ ইত্যাদি এলাকায় এখনও তাঁতশিল্প কিছুটা জীবিত। তবে উৎপাদনের খরচ ও মজুরি কম হওয়ায় এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিতে না পারায় এই শিল্পে আগ্রহ হারাচ্ছেন নতুন প্রজন্ম। একেকটি শাড়ি বুনতে দিন পেরিয়ে যায়, অথচ দাম মেলে মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকা। এতে সংসার চালানো সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছেন অনেক তাঁতী।
তবুও আশার আলো নিভে যায়নি। সরকারিভাবে তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। তৈরি হচ্ছে সমবায় প্রতিষ্ঠান, দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী ও প্রণোদনা। পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণও বাড়ছে এই শিল্পে, যা এক নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করছে। বর্তমানে তাঁতশিল্পে কর্মরত শ্রমিকের ৫৬ শতাংশই নারী, যেখানে এক যুগ আগেও তা ছিল মাত্র ৪৬ শতাংশ।

তাঁতশিল্প শুধু একটি বস্ত্রশিল্প নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সঠিক পদক্ষেপ ও কার্যকর সহায়তার মাধ্যমে এই শিল্প আবার ফিরে পেতে পারে তার হারানো গৌরব—এমনই আশা করছেন কারিগর, গবেষক ও সচেতন মহল।
গ্রামীণ তাঁতশিল্পের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে যদি রাষ্ট্র, সমাজ ও বাজার একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তবে এ শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে বাংলার গর্বিত ঐতিহ্য।