ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে জমির দলিল তৈরি ও হস্তান্তরের অভিযোগ

ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে জমির দলিল তৈরি ও হস্তান্তরের অভিযোগ

এক শ্রেণির সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও মোটা অঙ্কের অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে বেআইনিভাবে জমির দলিল তৈরি ও হস্তান্তরের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, নামজারির জন্য নির্ধারিত ফি থেকে পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি টাকা আদায় করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে না আসা, অভিযোগ পাওয়ার পরও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না করা, এবং মামলা চলমান থাকা সত্ত্বেও জমি হস্তান্তরের ঘটনা ঘটছে ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবা সংস্থায় নিয়োজিত দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ ধরনের অনিয়ম বেড়ে চলেছে।

সরকারি জমির খারিজ বা নামজারির ফি মাত্র ১ হাজার ১৭০ টাকা হলেও, ভূমি অফিসগুলোতে জমির ধরন অনুযায়ী দলিল প্রতি ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইল সদরের ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের কথোপকথনে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফতেপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মাসুদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, নামজারি করতে ৫ হাজার ৫০০ টাকা ফি লাগবে। এ বিষয়ে তার সহযোগী সোহাগ বলেন, “যদি টাকা কমাতে চান, স্যারের সঙ্গে কথা বলুন। তবে ফোনে এসব আলোচনা ঝামেলা হতে পারে। আমার বিকাশ নম্বরে সাত-আট হাজার টাকা পাঠিয়ে দিন।”

২৬ জানুয়ারি ২০২৫, রাজধানী ডেমরার বাঁশেরপুল সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, ৬-৭ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাননি। তারা বলেন, টাকা ছাড়া কোনো ফাইল এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে চলে না। মিজানুর রহমান নামে একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে পৈতৃক সম্পত্তি অন্যদের নামে রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে, যা আইনগতভাবে অবৈধ।

কেরানীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে খাজনা নিয়ে ভূমি হস্তান্তরের অভিযোগ উঠেছে, যা নিবন্ধন অধিদফতরে গড়িয়েছে। এক ভুক্তভোগী জানান, তার জমি নিয়ে মামলা চলমান থাকার পরও সাব-রেজিস্ট্রার ভূমি রেজিস্ট্রি করেছেন, ফলে তিনি মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এদিকে, তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে সময় সংবাদের উপস্থিতি টের পেয়ে মোহাম্মদপুরের সাব-রেজিস্ট্রার শাহিন আলম রুম থেকে বের হয়ে যান। পরে খাস কামরায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেও ক্যামেরায় তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার আরিফুর রহমানও চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে কর্মরত অবস্থায় অভিযোগের বিষয়ে কথা বলেননি এবং জানান, অফিসিয়ালি এ বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই।

আইনজীবীরা বলছেন, ভূমি রেজিস্ট্রেশন আইনে সাব-রেজিস্ট্রারদের দায়মুক্তি দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বায়েজিদ ইসলাম বলেন, সেকশন ৮৬ অনুযায়ী, সরল বিশ্বাসে জমি কিনে রেজিস্ট্রেশন করা হলে ক্রয়দাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়, যা প্রায় দায়মুক্তির মতো।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। যারা দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্বে রয়েছেন, তারাও কোনো না কোনোভাবে এর সুবিধাভোগী। ফলে বিচারহীনতার মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে।

টিআইবি মনে করছে, ভূমি ব্যবস্থাপনাকে পুরোপুরি ডিজিটাল করে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করলে নাগরিকরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবেন।

CATEGORIES
TAGS
Share This